করোনা থেকেও সড়ক ভয়ংকর!

Passenger Voice    |    ০১:৩৫ পিএম, ২০২০-০৮-১২


করোনা থেকেও সড়ক ভয়ংকর!

মো. শাহ জালাল মিশুক:  করোনা প্রতিরোধে বিশ্ব রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। বৈশ্বিক এ দুর্যোগ বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করেছে। তবে দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকাংশে করোনার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা; বড় হচ্ছে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, গত শুক্রবার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্না। রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন লেক রোডে সাইক্লিং করার সময় একটি প্রাইভেট কার পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চাপা দেয় তাকে।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে এখন পর্যন্ত ৮-১০ জন মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। কিন্তু হাসপাতালসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, এ মৃত্যুর গড় ১৫-১৬ জন। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে বলে উঠে এসেছে সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে করা 'নিরাপদ সড়ক চাই'-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে। পাশাপাশি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮৮ জন নিহত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই হাজার ১২৩ জন নিহত হয় বলে জানিয়েছে যাত্রীকল্যাণ সমিতি। অন্যদিকে দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মারা যায় ১৬৮ জন। এমনকি গত ২৬ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হলেও লকডাউনের এক মাসে ২০১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ২১১ জন নিহত ও ২২৭ জন আহত হয়েছে। অর্থাৎ লকডাউনের মধ্যে দেশব্যাপী গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলেও চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় করোনার চেয়েও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাশাপাশি এ বছরের মে মাসে ২১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ২৯২ জন ও জুন মাসে ৩৫৮টি দুর্ঘটনায় ৩৬৮ জন মানুষ নিহত ও ৫১৮ জন আহত হয়। এসব তথ্য বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধে ব্যস্ত, সেখানে বাংলাদেশকে ভাবতে হচ্ছে মহামারি প্রতিরোধের পাশাপাশি সড়কগুলোতে কীভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে সাধারণ মানুষের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করা যায়।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ ও অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাওয়া যায়। যার মধ্যে দুর্ঘটনার জন্য বেশিরভাগ সময় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনা, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং চালকের অদক্ষতাকেই দায়ী করা হয়। পাশাপাশি যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা এবং মাদক সেবন করে যানবাহন চালানোর ফলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাস্তায় ফুটপাত না থাকা কিংবা ফুটপাত বেদখল হয়ে যাওয়া এবং ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগও বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার বিশেষ কারণ হিসেবে উঠে আসছে।

যেহেতু সড়কে শান্তি ফিরিয়ে এনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কমিয়ে আনা দিন দিন দুস্কর হয়ে যাচ্ছে। তাই অতিদ্রুত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে সড়কে যাত্রীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় অতি শিগগির দেশব্যাপী চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নিতে হবে। গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি গণপরিবহন চালকদের প্রফেশনাল ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক চিহ্নগুলো (যেমন স্পিডব্রেকার, জেব্রাক্রসিং) স্পষ্ট থাকে না যা খুবই বিপজ্জনক। তাই এই ট্রাফিক চিহ্নগুলো স্পষ্টভাবে অঙ্কন ও স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি অতিদ্রুত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলোকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু মৃত্যুর মিছিলই বড় হচ্ছে না; পাশাপাশি অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে এবং দেশও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধের পাশাপাশি অতি দ্রুত সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যাত্রীদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে গেলেও সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।